গর্ভাবস্থায় জরায়ু নিচে নামার লক্ষণ য় কি জানতে পাঠকদের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক কৌতূহল। দেশের নারীরা কিছু সমস্যার কথা অন্যের কাছে বলতে লজ্জাবোধ করেন। যত দিন সম্ভব সমস্যার কথা চেপে রাখেন। একপর্যায়ে রোগটা জটিল আকার ধারণ করে। জরায়ু নিচের দিকে নেমে যাওয়া এমনই একটি সমস্যা। বিভিন্ন কারণে জরায়ু স্থানচ্যুতি ঘটতে পারে। লিগামেন্ট নামক দড়ির মতো কাঠামোর দ্বারা জরায়ুটি জায়গায় থাকে। কোনো কারণে এই গঠন দুর্বল হলে জরায়ুর অবস্থান স্বাভাবিক থাকে না।
তাই আপনাদের সুবিধার্থে আজকের আর্টিকেলে আমরা নরজরায়ু নিচে নামার কারন, গর্ভাবস্থায় জরায়ু নিচে নামার লক্ষণ, গর্ভাবস্থায় জরায়ু মুখ খোলার লক্ষণ, জরায়ু নিচে নেমে গেলে কিভাবে বুঝবো, জরায়ু নিচে নেমে গেলে করণীয় কি তা নিয়ে আলোচনা করব। তাহলে চলুন প্রতিবেদনটি শুরু করা যাক:
জরায়ু নিচে নামার কারন
জরায়ু নিচে নামার (uterine prolapse) প্রধান কারণ হলো পেলভিক মাংসপেশি এবং লিগামেন্টগুলোর দুর্বল হয়ে যাওয়া, যা জরায়ুকে সঠিক স্থানে ধরে রাখে। কিছু পেশী এবং লিগামেন্ট জরায়ুকে জায়গায় রাখতে সাহায্য করে। কেউ দুর্বল গঠন নিয়ে জন্মালে এই সমস্যা হতে পারে।
এ সমস্যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন:
- গর্ভধারণ এবং প্রসব: বারবার গর্ভধারণ এবং স্বাভাবিক প্রসব জরায়ুর নিচে নামার অন্যতম প্রধান কারণ। প্রসবের সময় পেশির ওপর চাপ পড়ে এবং এটি দুর্বল হয়ে যায়।
- বয়স এবং মেনোপজ: বয়স বাড়ার সাথে সাথে এবং মেনোপজের পর এস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা কমে যাওয়ার ফলে পেলভিক মাংসপেশি দুর্বল হতে থাকে।
- ভারী কাজ বা ওজন তোলা: ভারী কাজ বা ওজন তোলা পেটের চাপ বাড়িয়ে পেলভিক মাংসপেশিতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
- জন্মগত দুর্বলতা: কিছু মহিলার পেশি ও লিগামেন্ট জন্মগতভাবে দুর্বল থাকে, যা জরায়ু নিচে নামার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- জটিলতা বা পেটের চাপ বৃদ্ধি: দীর্ঘমেয়াদি কাশি, কোষ্ঠকাঠিন্য, বা স্থূলতার কারণে পেটের চাপ বৃদ্ধি পেলে জরায়ু নিচে নামার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- অতিরিক্ত ওজন: ওজন বেশি হলে পেটের মাংসপেশিতে অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যা পেশিকে দুর্বল করে দিতে পারে।
- সার্ভিক্স সম্পূর্ণ প্রসারিত হওয়ার আগে প্রসবের সময় অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা হলে।
- যদি প্রসব 12 থেকে 16 ঘন্টার বেশি স্থায়ী হয় এবং প্রসবের সময় জরায়ু নিচের দিকে ছিঁড়ে যায়।
- অল্প ব্যবধানে আরেকটি সন্তান গর্ভধারণ করা। দুই শিশুর বয়সের ব্যবধান এক বছরের কম হলে ঝুঁকি বেশি।
- যখন জরায়ুর পেশী সহ সহায়ক কাঠামো বয়সের সাথে দুর্বল হয়ে যায়।
- দীর্ঘ সময় ধরে কাশি, কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে।
- অনুপযুক্ত প্রসব পরবর্তী যত্ন এবং ভারী উত্তোলন।
জরায়ু নিচে নামা একটি সাধারণ সমস্যা হলেও সময়মতো চিকিৎসা না করলে এটি আরও জটিল হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় জরায়ু নিচে নামার লক্ষণ
এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২৪৪১তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন দেলোয়ার হোসেন। তিনি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন। যখন প্রল্যাপস হয়, তখন যোনিতে ভারী কিছু অনুভূত হয়। তলপেট ভারী মনে হবে। আরেকটি বিষয়, কোমর ব্যথা, কোমর ব্যথা। যখন আমরা সেগুলি নিয়ে আসি, তখন আমরা প্রল্যাপসের মাত্রা নির্ধারণ করি। এখন কি করতে হবে? প্রথম পর্যায়ে প্রল্যাপস ঠিক আছে। তুমি ভারী জিনিস তুলবে না।
যদি দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রল্যাপস হয় এবং রোগী যদি অল্পবয়সী হয়, যদি তার পারিবারিক জীবন পূর্ণ না হয়, তবে আমরা একটি অস্ত্রোপচার করি। যতটুকু বের হবে, ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নিন। এর পর আমরা তাকে পরামর্শ দেই। পরে সন্তান ধারণ করলে গর্ভপাত হতে পারে। কিন্তু গর্ভপাতেরও একটা চিকিৎসা আছে। তারপরে আমরা এমনভাবে মুখ বেঁধে রাখি যাতে শিশুটি পড়ে না যায়।
এবং যদি এটি তৃতীয় পর্যায়ে থাকে তবে আমরা এটিকে ফেলে দেওয়ার পরামর্শ দিই।
গর্ভাবস্থায় জরায়ু নিচে নামার (uterine prolapse) লক্ষণগুলো সাধারণত পেলভিক অঞ্চলের অস্বস্তি বা চাপ দিয়ে শুরু হয়। এই অবস্থায় নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে:
জরায়ু নিচে নেমে গেলে কিভাবে বুঝবো
- পেলভিক অঞ্চলে ভারী লাগা বা চাপ অনুভব করা: পেলভিক অঞ্চলে ভারীভাব, নিচের দিকে টান অনুভব হতে পারে, যা দিন শেষে বেশি অনুভূত হয়।
- যোনির মধ্যে বা বাইরে কিছু বেরিয়ে আসার অনুভূতি: যোনির মধ্যে বা বাইরে কিছু যেন বেরিয়ে আসছে এমন অনুভূতি হতে পারে, যা জরায়ুর নিচে নেমে আসার একটি স্পষ্ট লক্ষণ।
- পিঠের নিচের অংশে ব্যথা: বিশেষ করে কোমরে বা পিঠের নিচের অংশে চাপ বা ব্যথা হতে পারে, যা দাঁড়ালে বা হেঁটে বেড়ালে বাড়তে পারে।
- মূত্রত্যাগে সমস্যা: প্রস্রাব করার সময় সমস্যা হতে পারে, যেমন বারবার প্রস্রাবের চাপ লাগা বা পুরোপুরি প্রস্রাব শেষ করতে না পারা।
- মলত্যাগে সমস্যা: কোষ্ঠকাঠিন্য বা মলত্যাগ করতে কষ্ট হতে পারে।
- যোনিতে অস্বাভাবিক স্রাব: সাদা বা হালকা রঙের স্রাব বেড়ে যেতে পারে, যা পায়ের অংশে বা অন্তর্বাসে ভিজে যাওয়ার কারণ হতে পারে।
- যোনিতে ফোলা অনুভব করা: জরায়ু নিচে নামলে যোনি অঞ্চলে ফোলা বা অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা দিতে পারে।
- সহবাসে অস্বস্তি বা ব্যথা: গর্ভাবস্থায় জরায়ু নিচে নামার কারণে সহবাসে ব্যথা বা অস্বস্তি হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় জরায়ু নিচে নামার সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এতে প্রসবের সময় এবং গর্ভাবস্থার বিভিন্ন জটিলতা এড়ানো সম্ভব হতে পারে।
read more: নরমাল ডেলিভারির পর সেলাই শুকানোর উপায় । শুকাতে কতদিন লাগে
গর্ভাবস্থায় জরায়ু মুখ খোলার লক্ষণ
গর্ভাবস্থায় জরায়ুর মুখ (cervix) খোলা একটি জটিল অবস্থা, যা প্রি-টার্ম লেবারের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই অবস্থাটি অনেক সময় সার্ভিক্যাল ইনসাফিসিয়েন্সি বা সার্ভিক্যাল ইনকম্পিটেন্স নামে পরিচিত। এর কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে, যা লক্ষ্য করলে দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত। লক্ষণগুলো নিম্নরূপ:
- পেলভিক অঞ্চলে চাপ বা ভারী লাগা:
জরায়ুর মুখ খোলার সাথে সাথে পেলভিক অঞ্চলে একটি অস্বাভাবিক চাপ অনুভূত হতে পারে, যা নিচের দিকে টান অনুভব করায়। বিশেষ করে দাঁড়িয়ে বা হাঁটলে এই চাপ বাড়তে পারে।
- পিঠের নিচের দিকে ব্যথা:
পিঠের নিচের দিকে এক ধরনের ক্রমাগত ব্যথা হতে পারে, যা সাধারণত বিশ্রাম নেওয়ার পরও কমে না।
- তলপেটে অস্বস্তি বা ক্র্যাম্পিং:
অনেক সময় তলপেটে মৃদু ব্যথা বা ক্র্যাম্প হতে পারে, যা মাসিকের ব্যথার মতো অনুভূত হয়। এটি জরায়ুর মুখ খোলার একটি সতর্ক সংকেত হতে পারে।
- যোনি দিয়ে স্রাব বেড়ে যাওয়া:
জরায়ুর মুখ খোলার কারণে সাদা বা হালকা রঙের তরল স্রাব বৃদ্ধি পেতে পারে। এটি অনেক সময় বেশি পাতলা বা জলের মতো হতে পারে।
- হালকা রক্তপাত বা স্পটিং:
জরায়ুর মুখ খোলার ফলে হালকা রক্তপাত বা স্পটিং হতে পারে, যা গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিক নয়।
- শিশুর চলাচল বা নড়াচড়ায় অস্বাভাবিকতা:
গর্ভের শিশুর গতিবিধি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বা কম হতে পারে। এই ধরনের পরিবর্তন জরায়ুর মুখ খোলার ইঙ্গিত হতে পারে।
- যোনি দিয়ে চাপ বা ফোলা অনুভব করা:
যোনির মধ্যে কিছু যেন বেরিয়ে আসছে বা ফোলা অনুভব হলে এটি জরায়ুর মুখ খোলার লক্ষণ হতে পারে।
জরায়ু নিচে নেমে গেলে করণীয় কি
জরায়ু নিচে নেমে গেলে (uterine prolapse) প্রাথমিক চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা নির্ভর করে সমস্যার স্তর এবং রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর। নিচে কিছু সাধারণ করণীয় এবং চিকিৎসার উপায় উল্লেখ করা হলো:
- জরায়ু নিচে নামার পর্যায় মূল্যায়ন:
চিকিৎসক প্রথমে সমস্যার স্তর নির্ধারণ করবেন। জরায়ু সামান্য নেমে এলে সহজ উপায়ে সমাধান করা যেতে পারে, কিন্তু যদি তা বেশি হয়, তবে আরও জটিল চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
- জীবনযাত্রার পরিবর্তন:
- ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন পেলভিক অঞ্চলে চাপ বাড়ায়। ওজন নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
- ভারী ওজন তোলা এড়ানো: ভারী কাজ বা ভার তোলার কাজ যতটা সম্ভব এড়াতে হবে।
- কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ: পর্যাপ্ত আঁশযুক্ত খাবার এবং পানি পান করে কোষ্ঠকাঠিন্য এড়ানো যেতে পারে, যা পেলভিক অঞ্চলে চাপ কমাবে।
- দীর্ঘস্থায়ী কাশি নিয়ন্ত্রণ: কাশি হলে তার জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে, কারণ দীর্ঘস্থায়ী কাশি পেলভিক মাংসপেশিতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
- কেজেল ব্যায়াম:
কেজেল ব্যায়াম পেলভিক মাংসপেশিকে শক্তিশালী করে, যা জরায়ুকে তার স্থানে ধরে রাখতে সাহায্য করতে পারে। নিয়মিত এই ব্যায়াম করলে সমস্যা হ্রাস পেতে পারে।
- পেসারি ডিভাইস:
চিকিৎসক জরায়ুকে সঠিক স্থানে ধরে রাখতে যোনির মধ্যে পেসারি নামের একটি বিশেষ ডিভাইস রাখতে পারেন। এটি যোনির ভেতরে একটি প্লাস্টিক বা রাবারের রিং, যা জরায়ুকে সাপোর্ট করে।
- হরমোন থেরাপি:
বিশেষ করে মেনোপজের পরের নারীদের জন্য এস্ট্রোজেন থেরাপি পেশিগুলোর ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। এটি পেলভিক মাংসপেশি ও লিগামেন্টগুলোকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
- শল্যচিকিৎসা (সার্জারি):
জরায়ু যদি খুব বেশি নেমে আসে এবং অন্যান্য চিকিৎসা কার্যকর না হয়, তবে শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। কিছু প্রচলিত শল্যচিকিৎসার উপায় হল:
- পেলভিক রিকনস্ট্রাকশন: পেশি ও লিগামেন্টগুলোকে পুনরায় সঠিক স্থানে স্থাপন করা।
- হিস্টেরেকটমি (জরায়ু অপসারণ): কিছু ক্ষেত্রে জরায়ু পুরোপুরি অপসারণ করার পরামর্শ দেওয়া হতে পারে, বিশেষ করে যদি রোগী সন্তানধারণের ইচ্ছা না রাখেন।
- পর্যবেক্ষণ এবং নিয়মিত চিকিৎসক পরামর্শ:
নিয়মিত চেকআপ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি, যাতে সমস্যার অবনতি না হয় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সময়মতো নেওয়া যায়।
প্রাথমিক পর্যায়ে সমস্যাটি চিহ্নিত করলে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে জরায়ু নিচে নামার সমস্যাটি সহজে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
শেষ কথা
প্রিয় দর্শক বন্ধুরা আজকের আর্টিকেলে আমরা জরায়ু নিচে নামার কারন, গর্ভাবস্থায় জরায়ু নিচে নামার লক্ষণ, গর্ভাবস্থায় জরায়ু মুখ খোলার লক্ষণ, জরায়ু নিচে নেমে গেলে কিভাবে বুঝবো, জরায়ু নিচে নেমে গেলে করণীয় কি তা নিয়ে আলোচনা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটা বুঝতে আপনাদের কোন অসুবিধা হয়নি এবং আপনারা উপকৃত হয়েছে। এই সম্বন্ধে যদি কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে কমেন্টে করুন। শীঘ্রই আপনার কমেন্ট মূল্যায়ন করা হবে ইনশাল্লাহ।
আরো পড়ুন :- সিজারে বাচ্চা হওয়ার কত দিন পর সহবাস করা যায়
tag: জরায়ু নিচে নামার কারন, গর্ভাবস্থায় জরায়ু নিচে নামার লক্ষণ, গর্ভাবস্থায় জরায়ু মুখ খোলার লক্ষণ, জরায়ু নিচে নেমে গেলে কিভাবে বুঝবো, জরায়ু নিচে নেমে গেলে করণীয় কি, gorbo obostay jorau nice namar lokhon, biborun.com